পুরুলিয়ার মেয়ের ভেনিস চলচ্চিত্র

 পুরুলিয়ার মেয়ের ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব জয়: অনুপর্ণা রায়ের সাফল্যের কাহিনি






সূচনা: ছোট গ্রাম থেকে বিশ্বমঞ্চে


পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা—প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর লোকশিল্পের জন্য বহুল পরিচিত। এই জেলার নিতুড়িয়া ব্লকের নারায়ণপুর গ্রাম থেকে উঠে আসা এক তরুণী আজ বিশ্ব চলচ্চিত্রের মঞ্চে আলোড়ন তুলেছেন। তাঁর নাম অনুপর্ণা রায়। ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৫-এর অরিজ্জোন্তি বিভাগে তিনি জয় করলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান। এটি শুধু বাংলার জন্য নয়, সমগ্র ভারতের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন।


বেড়ে ওঠা: সাধারণ জীবনের অসাধারণ স্বপ্ন

অনুপর্ণার শৈশব কেটেছে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের পরিবেশে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, মা একজন গৃহিণী। পরিবারের আশা ছিল মেয়ে ভালো পড়াশোনা করে স্থায়ী চাকরির পথে হাঁটবে। ছোটবেলা থেকেই অনুপর্ণা ছিলেন মেধাবী ও কৌতূহলী। বই পড়া, গল্প লেখা ও নাটকে অংশ নেওয়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ।

তবে সিনেমা যে তাঁর জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠবে, সে কথা তখন কেউই কল্পনা করেননি—এমনকি নিজেও না।


শিক্ষাজীবন থেকে কর্পোরেট জগৎ

স্কুলজীবন শেষ করে অনুপর্ণা ভর্তি হন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে। স্নাতক সম্পন্ন করার পর, বাবা-মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতেই তিনি চাকরির সন্ধানে নামেন। কিছুদিনের জন্য তিনি কর্পোরেট দুনিয়ায় কাজও করেছিলেন। নিয়মিত বেতন, নির্দিষ্ট জীবনযাপন—সব কিছুই ছিল ঠিকঠাক। কিন্তু অন্তরের ভেতর যেন এক অদৃশ্য শূন্যতা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।

কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ততার মাঝেই অনুপর্ণা উপলব্ধি করলেন—এই জীবন তাঁর জন্য নয়। তিনি খুঁজে ফিরছিলেন সেই জায়গা, যেখানে নিজেকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারবেন। আর সেই খোঁজ তাঁকে নিয়ে গেল শিল্পের দুনিয়ায়।


শিল্পের পথে প্রথম পদক্ষেপ

চাকরি ছেড়ে অনুপর্ণা ভর্তি হলেন অনুপম খেরের অ্যাক্টিং স্কুলে। পরিবারে প্রথমে এই সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয়নি। বাবা-মা আশঙ্কা করেছিলেন—অভিনয় কিংবা সিনেমার মতো অনিশ্চিত পথে হাঁটলে জীবনে স্থিতি আসবে না। কিন্তু অনুপর্ণা নিজের মনকে অনুসরণ করার সাহস দেখালেন।

অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিতে নিতে তিনি বুঝতে পারলেন, কেবল অভিনয় নয়—চলচ্চিত্র নির্মাণই তাঁর সত্যিকারের ডাক। মানুষের গল্প, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপন তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিত। সেই অনুভবই সিনেমা বানানোর স্বপ্নকে জন্ম দেয়।


জন্ম নেয় Songs of Forgotten Trees

অনুপর্ণার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র Songs of Forgotten Trees যেন তাঁর জীবনদর্শনের প্রতিফলন। ছবির কাহিনি দুই অভিবাসী নারীর গল্প ঘিরে। মুম্বই শহরের ব্যস্ততা, নিঃসঙ্গতা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর মানুষে মানুষে সম্পর্কের উষ্ণতা এই ছবির মূল উপজীব্য।

চলচ্চিত্রে অনুপর্ণা মিশিয়েছেন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা, ছোট গ্রামের বাস্তবতা, সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাহিনি এবং নারীর সংগ্রামের অন্তর্দ্বন্দ্ব। সহজ অথচ কাব্যিক ভঙ্গিতে গল্প বলার ক্ষমতা দর্শক ও সমালোচক—উভয়ের মন জয় করে নেয়।


আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

২০২৫ সালে Songs of Forgotten Trees নির্বাচিত হয় ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অরিজ্জোন্তি বিভাগে। এই বিভাগ মূলত উদীয়মান প্রতিভাদের জন্য। প্রথম ছবিতেই অনুপর্ণা এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে জায়গা করে নেন, যা সত্যিই বিরল।

পুরস্কার ঘোষণার দিন যখন তাঁর নাম মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়, সমগ্র দর্শকাসনে করতালি বেজে ওঠে। সাদা শাড়ি পরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনুপর্ণার কণ্ঠ ভেসে ওঠে—

“এই সম্মান আমি উৎসর্গ করছি প্রতিটি নারীর প্রতি, যাদের কণ্ঠস্বর দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে গেছে।”

এই একটিমাত্র বাক্য যেন হয়ে উঠল সমগ্র উৎসবের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত।


পরিবারের প্রতিক্রিয়া

যে বাবা একসময় মেয়ের সিনেমার স্বপ্ন নিয়ে দোটানায় ছিলেন, আজ সেই বাবা মেয়েকে দেখে গর্বে ভরে উঠেছেন। মা-ও আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। গ্রাম নারায়ণপুরের মানুষরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে উদ্‌যাপন করেছেন তাঁদের মেয়ের এই সাফল্য।

পুরুলিয়ার গর্ব, বাংলার গর্ব

অনুপর্ণার এই জয় কেবল একটি ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং সমগ্র পুরুলিয়া তথা বাংলার জন্য এক অসীম গৌরব। সাধারণ একটি গ্রাম থেকে উঠে এসে বিশ্বমঞ্চে জয় ছিনিয়ে আনা প্রমাণ করে—স্বপ্নের কোনও ভৌগোলিক সীমা নেই।


অনুপ্রেরণার বার্তা

অনুপর্ণা রায়ের জীবনকাহিনি এক প্রকার রূপকথা। তবে এই রূপকথার পেছনে আছে কঠোর পরিশ্রম, সাহসী সিদ্ধান্ত ও আত্মবিশ্বাস। তিনি দেখিয়ে দিলেন—


জন্মস্থান নয়, স্বপ্নই মানুষকে বড় করে তোলে।

সাহস থাকলে পরিবারের প্রত্যাশার বাইরে গিয়েও নিজের পথ তৈরি করা যায়। শিল্প কেবল বিনোদন নয়, এটি মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে।

আজ অনুপর্ণা রায় শুধু একজন সফল পরিচালক নন, বরং এক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন—একটি ছোট গ্রাম থেকেও বিশ্বকে আলোড়িত করা যায়, যদি স্বপ্ন দেখার সাহস থাকে। তাঁর জয় কেবল পুরুলিয়ার নয়, সমগ্র ভারতের জয়।

মন্তব্যসমূহ