হীরক রাজার দেশে’র সেই পাহাড় – জয়চন্ডী ভ্রমণ গাইড !! Jaychandi Hills are the pride of Purulia


 

জয়চন্ডী পাহাড়: পুরুলিয়ার গর্ব, প্রকৃতি ও ইতিহাসের মিলনস্থল

লেখক: আকাশ বাউরী 
স্থান: পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ
ব্লগ: হ্যামদের পুরুলিয়া (Hamder Puruliya)

পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বুকে অবস্থিত জয়চন্ডী পাহাড় এক অনন্য সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র, যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অ্যাডভেঞ্চার মিশে এক অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। রঘুনাথপুর শহরের নিকটে এবং আসানসোল থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত এই পাহাড়টি শুধু মাত্র পাহাড়ই নয়, এটি একটি আত্মিক ও প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার কেন্দ্র



ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব

জয়চন্ডী পাহাড়ের শীর্ষে অবস্থিত জয়চন্ডী দেবীর মন্দির, যা এই পাহাড়টির নামের উৎস। প্রায় ৪০০টি খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দর্শনার্থীরা পৌঁছাতে পারেন এই পবিত্র স্থানে। প্রতি বছর প্রচুর ভক্ত এই মন্দিরে আসেন পূজা দিতে, বিশেষ করে নবমী ও চণ্ডীপুজোর সময়।

স্থানীয় লোককথা অনুসারে, এই পাহাড়টি বহু পুরনো কালের সাক্ষী। আদিবাসী সংস্কৃতির গভীর প্রভাব এখানে লক্ষ্য করা যায়, এবং এখানকার মানুষের বিশ্বাসে জয়চন্ডী দেবী হচ্ছেন শক্তির প্রতীক।




রক ক্লাইম্বিং ও ট্রেকিং প্রেমীদের স্বর্গ

জয়চন্ডী পাহাড় বাংলার রক ক্লাইম্বিং-এর জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। ১৯৬০-এর দশক থেকে এখানে রক ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষণ শিবির অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিশাল গ্রানাইট পাথরের গঠন, খাড়া প্রাচীর এবং গুহার মতো গঠন এটি কে একটি উপযুক্ত অ্যাডভেঞ্চার স্পট করে তুলেছে।

ট্রেকার ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান। যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন এবং একটু চ্যালেঞ্জ নিতে চান, তাদের জন্য জয়চন্ডী পাহাড় এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা দিতে পারে।


সত্যজিৎ রায় ও ‘হীরক রাজার দেশে’

জয়চন্ডী পাহাড় চিরদিনের জন্য বাঙালির মনে জায়গা করে নিয়েছে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) সিনেমার মাধ্যমে। এই পাহাড়ের অদ্ভুত গঠন, ট্রাইবাল পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই সিনেমার দৃশ্যপটের জন্য একেবারে উপযুক্ত ছিল।

যারা বাংলা সিনেমা ভালোবাসেন, তারা আজও এই পাহাড়ে এসে সিনেমার দৃশ্যগুলো মনে করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এই সিনেমার হাত ধরে জয়চন্ডী পাহাড় বাংলার সংস্কৃতি এবং পর্যটনে নতুন মাত্রা পায়।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট

জয়চন্ডী পাহাড় শুধু একটি ধর্মীয় বা অ্যাডভেঞ্চার স্পট নয়, এটি এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। চারদিকে ঘন শালবন, গ্রামের প্রান্ত, ছোট ছোট ঝর্না, এবং নিরিবিলি পরিবেশ — সবকিছু মিলিয়ে এক শান্ত, নির্মল পরিবেশ তৈরি করেছে।

পাহাড়ের চূড়া থেকে চারিদিকে তাকালে দেখা যায় রঘুনাথপুর শহরের দৃশ্য, সবুজ ধানক্ষেত, এবং দূরবর্তী পাহাড়ের সারি। বর্ষাকালে এই এলাকায় সবুজের ছোঁয়া প্রাণ পেয়ে ওঠে এবং ঝরনাগুলি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।


লোকসংস্কৃতি ও ছৌ নাচের সংযোগ

জয়চন্ডী পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি ছৌ নৃত্যের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে চারিদা গ্রাম, যেখানে ছৌ মুখোশ তৈরি হয়। যদিও ছৌ নাচ সরাসরি পাহাড়ে হয় না, তবে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পৌরাণিক আবহ ছৌ নাচের ভাবনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

পর্যটকরা আশেপাশের গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে পারেন যেখানে ঐতিহ্যবাহী ছৌ শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলা ও সরাসরি কাজ দেখার সুযোগ রয়েছে।


পর্যটন উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

প্রতি বছর ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে এখানে ‘জয়চন্ডী পাহাড় পর্যটন উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলায় থাকে লোকসংগীত, আদিবাসী নাচ, হস্তশিল্পের প্রদর্শনী, রক ক্লাইম্বিং প্রদর্শনী এবং নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এই সময়টিই জয়চন্ডী পাহাড় ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত। আবহাওয়া মনোরম থাকে, ভিড়ও জমে এবং আনন্দের পরিবেশ থাকে চারদিকে।


কীভাবে যাবেন জয়চন্ডী পাহাড়ে

  • রেলপথে: নিকটবর্তী স্টেশন Joychandi Pahar Station, যা আসানসোল ও আদ্রা লাইনের মাঝে অবস্থিত।

  • সড়কপথে: রঘুনাথপুর থেকে ৫-৬ কিমি দূরে। আসানসোল বা পুরুলিয়া থেকেও বাস বা গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়।

  • বিমানপথে: নিকটবর্তী বিমানবন্দর হল দুর্গাপুর (Kazi Nazrul Islam Airport), প্রায় ৭০ কিমি দূরে।


কোথায় থাকবেন

রঘুনাথপুর, আদ্রা বা আসানসোলে বিভিন্ন হোটেল, লজ ও রিসোর্ট আছে। এছাড়া সরকার পরিচালিত পর্যটন হোটেল, হোমস্টে এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে ভাড়া বাড়িতেও থাকা যায়। উৎসবের সময় অবশ্যই আগে থেকেই বুকিং করে নেওয়া উচিত।


কিছু দরকারি পরামর্শ

  • সিঁড়ি অনেক খাড়া, তাই আরামদায়ক জুতো পড়ুন।

  • জল ও হালকা খাবার সঙ্গে রাখুন।

  • বর্ষাকালে পাথর পিচ্ছিল হতে পারে, সতর্ক থাকুন।

  • ভোর বা সূর্যাস্তের সময় উপরে উঠলে দারুণ দৃশ্য দেখা যায়।

  • মন্দিরে প্রবেশের সময় স্থানীয় নিয়ম-রীতি মেনে চলুন।


শেষ কথা

জয়চন্ডী পাহাড় শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি একটি অনুভূতির নাম। এখানে একদিকে আছে প্রকৃতির শান্ত সৌন্দর্য, অন্যদিকে আছে রোমাঞ্চের হাতছানি। ইতিহাস, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র এবং ধর্ম—সবকিছুর মিলনস্থল এই পাহাড়।

যদি আপনি প্রকৃতি ভালোবাসেন, নতুন কিছু অনুভব করতে চান, এবং একটু অ্যাডভেঞ্চার চান — তাহলে জয়চন্ডী পাহাড় আপনার জন্য উপযুক্ত গন্তব্য



মন্তব্যসমূহ